আমার বন্ধু ও পরিচিতজনের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক, কেউ কেউ সরাসরি দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বহুদিন ধরে তাঁরা বলার চেষ্টা করছেন, দেশে তো অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে এত হতাশার প্রয়োজন কী? বা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে লাভ কী, শেখ হাসিনার বিকল্প কী? গত প্রায় এক বছরে রিজার্ভ, প্রবৃদ্ধি ও বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার পর উন্নয়নের প্রচারণায় ভাটা পড়েছে। কিন্তু বিকল্প কী বা ক্ষমতায় অন্য কোনো দল এলে তো দেশ ডুবে যাবে, এমন মনোভাব ব্যক্ত করা অব্যাহত রয়েছে আগের মতো।
বলা বাহুল্য, এই মনোভাব আমাদের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সবচেয়ে জোরালো প্রেরণা ছিল অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা। আমাদের আদি (ও বর্তমানের) সংবিধান অনুসারে, প্রত্যেক নাগরিকের একটি ভোট এবং কোনো অজুহাতেই (যেমন সরকারবিরোধী বা পশ্চাৎপদ চিন্তার অধিকারী) এটি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। অবাধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দল দেশ শাসন করবে, এই স্পষ্ট নির্দেশনা আমাদের সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে রয়েছে। বিরোধী দল জিতে এলে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে—১৯৭২ সালের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর এই অঙ্গীকার প্রকাশের মধ্যেও আমরা এর প্রতিফলন দেখি।
আওয়ামী লীগের পক্ষে জোর করে এমন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ফেলা সম্ভব। সম্ভব নির্বাচন–উত্তরকালে বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে, এমনকি প্রয়োজনে বিএনপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (এই আওয়াজ কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থক ইতিমধ্যে তুলেছেন) একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে আরও দৃঢ় করে তোলা। কিন্তু এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে দেশকে। এতে দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা, বিভাজন ও ভোগান্তি বাড়বে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও নতজানু হয়ে একটি দলের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, অর্থনৈতিক অসাম্য ও অরাজকতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বিকল্প কী, নির্বাচনের দরকার কী, নির্বাচনে বিএনপি এলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে—এমন সব বক্তব্য প্রদান এবং এর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা আসলে একধরনের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ইচ্ছেমতো দল ও প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। এমনকি এতে কোনো নির্বাচন ছাড়াই সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে এই দর্শন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল যে আওয়ামী লীগ (বাকশালের মোড়কে) ছাড়া অন্য কারও দেশ শাসনের অধিকার নেই এবং জনগণকে কোনো বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া সমীচীন নয়।
সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা বিলুপ্ত করে শুধু নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত করার একতরফা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও সেটিই বজায় রাখার সংকল্প তাই একদলীয় কর্তৃত্ববাদী মনোভাব। আমার মনে আছে, ২০০৯ সালের নির্বাচনে ৩৬ বছর পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘আমরা বাকশালি দর্শনে বিশ্বাস করি।’ এরপর দলের আরও কেউ কেউ বাকশালি শাসনব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেছেন।
২.
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শুধু বাকশালের দর্শনের কথা বলেই থেমে থাকেনি, এটি কার্যকর করার জন্য দু–দুটো সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করেছে। জোটসঙ্গী দলগুলো এবং এমনকি সংসদে বিরোধী দলের ওপর নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এদেরকে তারই অঙ্গসংগঠনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। নিপীড়নমূলক আইনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং র্যাব, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ অন্য সব বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। জাতীয় নির্বাচন শুধু নয়, বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠন, ক্রীড়া ফেডারেশন এমনকি অবসরপ্রাপ্তদের সংগঠনে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে।
আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, একশ্রেণির সাংবাদিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এমনকি মানবাধিকারকর্মীর মধ্যেও আওয়ামী লীগ এই একদলীয় কর্তৃত্ববাদী দর্শন রোপণ করতে পেরেছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে হৃদয়ে বাকশাল ধারণের এই মানসিকতা। এই মানসিকতা পোষণকারী ব্যক্তিরা কথায় কথায় স্বাধীনতাসংগ্রামকালের আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক রাজনীতির গৌরবগাথা স্মরণ করেন। কিন্তু চিন্তায়–চেতনায় তাঁরা আসলে ১৯৭৫ সালের একদলীয় শাসনের মানসিকতাকে ধারণ করেন। যত দোষ-ত্রুটি থাকুক বা দেশের জন্য সর্বনাশমূলক কর্মকাণ্ড করুক না কেন, তাঁরা দেশের জনগণকে আওয়ামী লীগের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পক্ষপাতী নন।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই সুযোগ থাকতে পারে কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে।
৩.
আমি জানি কেউ কেউ হয়তো বলবেন, আওয়ামী লীগ তো ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন দিয়েছে এবং ২০২৪ সালেও দেবে। কিন্তু যে নির্বাচনে জনগণের পছন্দের প্রতিফলন হওয়ার কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই, তাকে দেশি বা বিদেশি কোনো দলিল অনুসারেই সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এই যুক্তিতে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করেছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপির শাসনামলে সংসদ থেকে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেছিল, এ দুটো দলকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে হরতাল, অবরোধসহ সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করেই বলেছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘চিরকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য একমাত্র রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হচ্ছে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা—এমন একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল দেশে। এই ঐকমত্য গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল আওয়ামী লীগ, তবে বিএনপিসহ বাকি দলগুলো এটি মেনে নিয়েছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব ছিল, কিন্তু নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে—এই অভিমত বড় দুটো দলসহ প্রায় সব দল ও নাগরিক সমাজ প্রদান করেছিল।
শেষ দুটো, বিশেষ করে ২০১৮ সালে সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে পারলে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব—এটি বলার সুযোগ আওয়ামী লীগের হয়তো থাকত। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কারচুপিপূর্ণ এই নির্বাচনের পর এটি বলার সুযোগ নেই। বরং গত দীর্ঘ ১৫ বছরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজেদের পছন্দমতো লোককে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকার বর্তমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনকে আরও অসম্ভব করে তুলেছে। কাজেই দলীয় সরকারের অধীনেই ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জেদ নির্বাচনের নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস, এটি মনে করার যুক্তি রয়েছে।
৪.
আওয়ামী লীগের পক্ষে জোর করে এমন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ফেলা সম্ভব। সম্ভব নির্বাচন–উত্তরকালে বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে, এমনকি প্রয়োজনে বিএনপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (এই আওয়াজ কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থক ইতিমধ্যে তুলেছেন) একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে আরও দৃঢ় করে তোলা। কিন্তু এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে দেশকে। এতে দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা, বিভাজন ও ভোগান্তি বাড়বে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও নতজানু হয়ে একটি দলের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, অর্থনৈতিক অসাম্য ও অরাজকতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া এমন নির্বাচন হলে মার্কিন ভিসা নীতি ও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেশে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও বাণিজ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, এর সঙ্গে আমেরিকার মিত্রদেশগুলো যোগ দিলে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস উঠতে পারে।
আগামী নির্বাচন দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার নির্বাচনও। আমাদের সবারই এই উপলব্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। হৃদয়ে বাকশাল নয়, হৃদয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের এই সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন