কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নামে আমেরিকান প্রেসক্রিপশন থেকে বের হয়ে অন্য শক্তির সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক রাখার প্রচেষ্টা আমেরিকান প্রভাব ও আধিপত্যের জন্য কী কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে? দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও অন্য ক’টি দেশের পর মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান মিত্ররা একের পর এক মার্কিন প্রতিপক্ষ শক্তির সাথে সম্পর্ক রক্ষার পর এখন কৌশলগত স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছে খোদ ইউরোপে।
‘অকাস’ চুক্তিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে বাইডেন প্রশাসনের টানাপড়েনের পর ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপ-আমেরিকা যে সাময়িক ঐক্য ফিরে এসেছিল বলে মনে হয়েছিল সেই ঐক্যে বড় ধরনের আঘাত এসেছে ম্যাক্রোঁর চীন সফর শেষের বক্তব্যে। ম্যাক্রোঁ চীনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে ইউরোপের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের’ কথাই উল্লেখ করেছেন। যার সরল অর্থ দাঁড়ায়, ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলজাত মৈত্রী বজায় রাখবে, তবে অন্য শক্তিসমূহের সাথেও স্বাধীনভাবে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারবে। আমেরিকার সাথে চীনের বৈরিতা বেইজিংয়ের সাথে ইউরোপের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাইওয়ান নিয়ে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
ম্যাক্রোঁর উল্টো সূরের গীত
ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের পর হুমকির মধ্যে পড়া ইউরোপীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ন্যাটো ও পশ্চিমা ঐক্য ধরে রাখার প্রয়োজন যখন সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছিল তখন ম্যাক্রোঁর উল্টো সুরের গীত ইউরোপীয় ঐক্যকে যে মাত্রায় হোক না কেন বিপন্ন করেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের বক্তব্যে অন্য ইউরোপীয় দেশের সাড়া হয়তো সেভাবে মেলেনি, তবে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্রো ফিরে আসার পর পরই চীন সফরে গেছেন। তিনি চীনা নীতির কট্টর সমালোচক হলেও ভেতরে ভেতরে ভিন্ন কোন মেরুকরণের ইঙ্গিত সম্ভবত পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিধর দুই দেশের দুই নেতার পর পর চীন সফরে।
তাইওয়ান সম্পর্কে ম্যাক্রোঁর মন্তব্য নিয়ে ইউরোপ কার্যত যে মাত্রায় হোক না কেন বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নেদারল্যান্ডসে একটি রাষ্ট্রীয় সফরে, ফরাসি রাষ্ট্রপতি তাইওয়ান, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তার বিতর্কিত মন্তব্যের পরে ইউরোপীয়দের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে ভঙ্গুর ঐক্য গড়ে উঠেছে তা নাড়া খেয়েছে। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ১২ এপ্রিল আমস্টারডামে তার সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, ‘একজন মিত্র হওয়ার অর্থ প্রজা হওয়া নয়’। একই সংবাদ সম্মেলনে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক অপরিহার্য বলে উল্লেখ করে ইউরোপীয়দের এক সুরে কথা বলার আহ্বান জানান।
প্রকৃতপক্ষে, ম্যাক্রোঁর কথা তিনটি অপরিহার্য ও অত্যন্ত আন্তঃনির্ভর ইস্যুতে ইউরোপীয় পার্থক্য তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক, যার ইউক্রেনে জড়িত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; চীনের সাথে সম্পর্ক, যে দেশ রাশিয়ার কট্টর মিত্র; এবং দুই মহা শক্তির মধ্যে ইইউ-এর ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’, যা ফরাসি রাষ্ট্রপতির এখন রক্ষা করতে অসুবিধা হতে পারে, যদিও দাবি করেন যে তিনি এই এলাকায় ‘মতাদর্শিক যুদ্ধ’ জিতেছেন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল ছাড়া আর কেউ ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানকে সেভাবে সমর্থন দেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকেও ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা আসে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের অগ্রভাগে এবং গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগে রয়েছে, যা আরো উগ্র বিদেশী নীতির দিকে তাদের পরিচালিত করেছে। কিন্তু ম্যাক্রোঁর প্রতি আমেরিকানদের অসন্তোষ আমেরিকার আসল চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। মার্কিন সিনেটর মার্কো রুবিও দুই মিনিটের এক ভিডিওতে বারবার প্রশ্ন করেছেন যে, ম্যাক্রোঁ পুরো ইউরোপের পক্ষে কথা বলছেন কিনা। তিনি বলেছেন যে, ‘ইউরোপ যদি তাইওয়ান প্রশ্নে পক্ষ বেছে না নেয়, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনের হুমকির’ দিকে মনোনিবেশ করবে, আর আপনারা ইউক্রেন ও ইউরোপ পরিচালনা করেন।’ তিনি ফ্রান্স বা ইউরোপের প্রতি এ প্রশ্নের দ্রুত উত্তর দেয়ার আহ্বান জানান।
ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণ করার সুপ্ত ইচ্ছা ওয়াশিংটনের রয়েছে। এই কারণে ইউরোপীয় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ম্যাক্রোঁর জোরকে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ একটি রূপ হিসাবে দেখা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে হেনম্যান হিসেবে দেখছে। যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইউরোপের প্রয়োজন, তখন ইউরোপকে ফায়ারের লাইনে দাঁড়াতে হবে; যখন চীনকে দমন ও নিয়ন্ত্রণে ইউরোপের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তখন ইউরোপকে অবশ্যই তার নেতৃত্ব অনুসরণ করতে হবে।
ইউরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অর্পিত ভূ-রাজনৈতিক ভ‚মিকা আর ইউরোপের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন কাঠামোগতভাবে পরস্পরবিরোধী। ম্যাক্রোঁর এবারের চীন সফর এবং ইউরোপীয় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে তার বক্তব্য জনগণকে প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ঠাণ্ডা যুদ্ধ যখন দ্রুত শুরু হয়, তখন দ্য গল কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন জোরালোভাবে সমর্থন করেন। ন্যাটোর সমন্বিত সামরিক কাঠামো থেকে তিনি সরে আসেন এবং চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও খুব অসন্তুষ্ট করেছিল এবং ইউরোপে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বলা হয়, দ্য গল ফ্রান্সের স্বাধীন রাজনৈতিক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফ্রান্সকে প্রধান শক্তির মর্যাদায় নিয়ে যান।
এখন পরিস্থিতি একবারেই ভিন্ন। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনে লেগে থাকার কারণে ইউরোপ তার নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য বন্ধুদের হারাবে, নাকি কৌশলগত ভারসাম্য আরো ভালোভাবে বজায় রাখার ক্ষমতা পাবে সে প্রশ্ন জোরালোভাবে সামনে আসবে। ম্যাক্রোঁ ইউরোপকে আবারও ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছেন। দ্য গলবাদকে এগিয়ে নেয়া হোক বা দ্বন্দ্ব বেছে নেয়া হোক ইউরোপকে একটি পছন্দের দিকে যেতে হবে। আর এক্ষেত্রে ফ্রান্সের পাশাপাশি আরেকটি দেশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো জার্মানি।
জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রীর চীন সফর
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বিতর্কের মধ্যে চীন সফর করে এসেছেন। নিবিড় চীন-ইইউ মিথস্ক্রিয়াগুলোর মধ্যে আসা জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর চীন-ইইউ উচ্চ-পর্যায়ের বিনিময়ের একটি বড় পুনর্নির্মাণের ইঙ্গিত দেয়। আর এটি রাজনীতি ও অর্থনীতির পাশাপাশি জনগণ পর্যায়ে সহযোগিতা বাড়ানোর পথ প্রশস্ত করতে পারে বলে চীনা বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, জার্মান কর্মকর্তারা ম্যাক্রোঁর মতো চীনের প্রতি একই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন বলে আশা করা অবাস্তব, তবে এই মুখোমুখি হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ব্যবসা ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীন-জার্মানি সহযোগিতার যেখানে একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে সেখানে কিছু মতপার্থক্য দূর করতে এবং সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য এটি জরুরী।
বেয়ারবকের চীন সফরের আগে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে তিনি চীনকে একটি ‘প্রতিযোগী’, ‘পদ্ধতিগত প্রতিদ্ব›দ্বী’ এবং ‘বিশ্বব্যাপী প্লেয়ার’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন যে ক্রমবর্ধমানভাবে তার নিজস্ব নকশা অনুসারে বিশ্ব ব্যবস্থার রূপ দিতে চায়। বেয়ারবক বলেছেন, জার্মানির চীন থেকে অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণের কোনো আগ্রহ নেই, তবে তার অর্থনৈতিক নির্ভরতা হ্রাস করে ‘ঝুঁকিমুক্ত’ করার লক্ষ্য থাকবে।
নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে এবং তার মিত্রদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতামূলক বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন জার্মান কোম্পানিগুলো চীনের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মান অর্থনীতির দুটি শক্তিশালী ইঞ্জিন, ফক্সওয়াগন এবং রাসায়নিক কোম্পানি বিএএসএফ চীনে তাদের বিনিয়োগ প্রসারিত করছে। জার্মান মিডিয়া ডয়চে ভেলে জানিয়েছে যে, বেয়ারবক তিয়ানজিনের একটি স্কুলে জার্মান শেখানোর পাশাপাশি জার্মান কোম্পানির মালিকানাধীন একটি উইন্ড টারবাইন কারখানা পরিদর্শন করেছেন।
মার্কেলের যুগ থেকে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা দ্রুত বাড়ছে। বেয়ারবক চীনের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করার আহ্বান জানালেও জার্মান কোম্পানিগুলো তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে নিজস্ব কর্মপন্থা পছন্দ করেছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে, জার্মানির উচিত চীনের সাথে ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখা এবং অগ্রসর করা।
ম্যাক্রোঁ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ইউরোপের দ্বন্দ্বে আটকা পড়া এড়ানো উচিত এবং তাইওয়ানের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনুসারী’ হিসাবে কাজ করা উচিত নয়। ইউরোপের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং তাইওয়ান প্রশ্নে ম্যাক্রোঁর মন্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করে চীনে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বেরট্রান্ড লরথোলারি পর দিন গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, বিতর্ক করা এবং বিভিন্ন কণ্ঠ শোনা ভালো আর বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করা ফ্রান্সে লালিত বিষয়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন ম্যাক্রোঁর বক্তব্যে ওয়াশিংটনের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা আপনাকে বলতে চাই যে কিছু দেশ অন্য দেশগুলোকে স্বাধীন দেখতে চায় না এবং সবসময় অন্য দেশগুলোকে তাদের ইচ্ছা মেনে চলতে বাধ্য করতে চায়, কিন্তু কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন মেনে চললে আরো বেশি সম্মান এবং আরো বন্ধু পাওয়া যাবে।’
ম্যাক্রোঁর এই এজেন্ডা সামনে এগুনো মানে ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যে বিভাজন সুপ্ত থেকে প্রকাশ্যে আসা। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সফর সেটি এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।
ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা
চীনবিরোধী পশ্চিমা মিত্র হিসাবে পরিচিত ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক প্রশ্নে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি প্রথম জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে এক পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ভারতকে দক্ষিণ এশীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল দেশটি স্নায়ুযুদ্ধ সময়ের অবস্থান পাল্টে য্ক্তুরাষ্ট্র ও পশ্চিমের একান্ত মিত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু পশ্চিমের সাথে কৌশলগত সহযোগিতা বিষয়ে নানা চুক্তি স্বাক্ষরের পর অচিরেই দেখা যায় ভারত তার পুরোনো মিত্র রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক শুধু টিকিয়েই রাখছে না, সেই সাথে এস ৪০০ ও সু ৩০ বিমানসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে নতুন নতুন চুক্তি করছে। চীনের সাথে পুরোনো বাণিজ্য সম্পর্ক আরো চাঙ্গা হওয়ার পাশাপাশি ব্রিকস, হংকং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার অভিন্ন বন্ধন আরো জোরালো হচ্ছে। অথচ এর পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে কোয়াডেরও সদস্য হিসাবে ভূমিকা পালন করছে দিল্লি।
এসবের পেছনে নয়া দিল্লির যুক্তি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রীর পাশাপাশি ভারতের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ থাকতে হবে। অর্থাৎ অন্যান্য প্রতিপক্ষ শক্তিসমূহের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক রক্ষার অধিকার থাকতে হবে। ভারতের এই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নামে গাছের উপরেরটা আর নিচেরটা দুটোই খাওয়ার নীতি ওয়াশিংটন মেনে নিতে পারেনি।
বিশ্ব ফোরামসমূহে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দ্ব›দ্ব আসে সেখানে ভারত ভোটদানে বিরত থাকে। স্বার্থ দ্বন্দ্ব না থাকলে কোনো সময় রাশিয়াকে আবার কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে দিল্লি। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের পর জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য ফোরামের ভোটাভুটিতে সবসময় ভোট দানে বিরত থেকেছে ভারত। ইউক্রেন ইস্যু ছাড়াও দিল্লি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের আরেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মিয়ানমার ইস্যুতে। এই ইস্যুতে দিল্লি-বেইজিং-মস্কো এক সাথে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অনুসৃত নীতির একেবারে বিপরীতে গিয়ে।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও নয়া দিল্লির ভূমিকায় নেপাইডো নীতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতাত্তোরকাল বিশেষত পঁচাত্তরের পর পশ্চিমা মিত্র হিসাবে তার নীতি বিন্যাস করে এসেছে। বর্তমান সরকার তার প্রথম মেয়াদে সেটি অনুসরণ করেছে। কিন্তু বিগত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার সাথে সাথে চীন-রাশিয়া-ভারতের প্রতি একান্তভাবে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। ঢাকাও দিল্লির মতো কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের আওতায় চীন-ভারত-রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক নির্মাণ করতে থাকে। এতে উপেক্ষিত হতে থাকে আমেরিকান স্বার্থ।
ভারতের দৃষ্টান্ত মধ্যপ্রাচ্যেও অনুসৃত হতে শুরু করে। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত চীন ও রাশিয়ার সাথে বিশেষ সম্পর্ক নির্মাণ করতে শুরু করে। আরব বসন্তে বিপন্ন বোধ করা উপসাগরীয় দেশগুলো গণতন্ত্রকামীদের প্রতি আমেরিকান সমর্থন রয়েছে বলে মনে করে। ফলে তারা বিকল্প বিশ্ব শক্তির সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। বারাক ওবামার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নীতির সূচনা ঘটান। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুই জাতি সমাধান তত্ত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনে নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনকে উপেক্ষার নীতিতে সমর্থন জোগান। ট্রাম্পের জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্য দূত জারেদ কুশনার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা বাদ দিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের জন্য চাপ তৈরি করেন। এই চাপে আমিরাত, বাহরাইন, সুদান, মরক্কো, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়। একই পথে হাঁটে সৌদি আরব ও ওমান। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বীকৃতি দান থেকে বিরত থাকে।
ট্রাম্পের বিদায়ের পর জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তাদের নীতির অগ্রভাগে স্থান দেয়। এতে আরব বসন্তের পর ট্রাম্পের আমলে কিছুটা পুনঃঘনিষ্ঠ হওয়ার পর নতুন করে ওয়াশিংটনের দূরত্ব তৈরি হয় আরব শাসকদের সাথে। বিশেষত জ্যারেড কুশনারের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসাবে পরিচিতি পাওয়া মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয় বাইডেন প্রশাসনের। এতে চীন রাশিয়ার সাথে আগে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে জোরদার হতে থাকে সৌদি আরব ও আমিরাতের। এটিকে দুই দেশ ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ হিসাবে দেখতে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক প্রভাবশালী দেশ তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত মৈত্রী বজায় রেখে রাশিয়া ও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে থাকে। ন্যাটোর সদস্য দেশ হিসাবে তুরস্ক পাশ্চাত্যের কৌশলগত অবস্থানের একই লাইন বরাবর বজায় রেখে চলছিল। ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরদোগানকে উৎখাতের প্রচেষ্টার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয় প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকে আঙ্কারা চীন-রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়া শুরু করে। ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার হিসাবে এরদোগান দুই প্রতিপক্ষ শক্তির সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখার কঠিন কৌশল চালিয়ে যায়। আর এতে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ওয়াশিংটন আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এরদোগানের প্রতিপক্ষকে সর্বান্তকরণে সমর্থন দিতে শুরু করেছে।
আমেরিকার সামনে তার মিত্রদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের চ্যালেঞ্জ এখন এক নতুন পর্বে এসে দাঁড়িয়েছে, যে সময়টাতে চীন ও রাশিয়া এবং সে সাথে ব্রিকসের সদস্য ও সদস্য হতে আগ্রহী আরো কিছু দেশ বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এটি আমেরিকান আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তৃত রাখার প্রচেষ্টাকে নিঃসন্দেহে বড়ভাবে প্রভাবিত করবে। আর ম্যাক্রোঁ এটিকে অনেক জোরালোভাবে সামনে এনেছেন ইউরোপের কৌশলগত স্বাতন্ত্র্যের আওয়াজ তুলে। সামনের দিনগুলো চ্যালেঞ্জের হবে ইউরোপ আমেরিকা ও চীন-রাশিয়া সব পক্ষের জন্য।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন