আগামী নির্বাচনের আগের গল্পটা কী
09 January 2022, Sunday
আরব্য রজনীর শেহেরজাদের চেয়ে বেশি কিচ্ছা আর কে জানত? তাকে বলা হয় সব গল্পের জননী। রাত ভোর হয়ে যেত, কিন্তু তার গল্প ফুরাত না। পরের রাতে পুরোনো গল্পের লেজ থেকে বেরোত টান টান নতুন আরেক গল্প। এত তুখোড় কেচ্ছাকার হয়েও শেহেরজাদের গল্প-কাহিনির রাত এক হাজার একটির বেশি ছিল না। অথচ আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিনিধিরা কত হাজার রাত ধরে যে গল্প বলে চলেছেন, সেই ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে, তাঁদের গল্প বলা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। আরব্য রজনীর শিক্ষাটা তাঁরা ভালোভাবেই নিয়েছেন। তাঁদের এই মহিমার কথা আমাদের স্বীকার করা উচিত। বিশেষ করে সরকারি দলের কয়েকজন নেতার প্রশংসা করতে হয়, যাঁরা প্রতিদিন গল্প বলেন এবং ভোরের সূর্যের মতো তা একই সঙ্গে পুরোনো ও নতুন।
গল্প চলল তো ক্ষমতাও চলবে। ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ধরে সভ্যতা ও আইনের গল্প শুনিয়ে পরাধীন রেখেছিল আমাদের। অথচ পাকিস্তানিদের মুসলিম মিল্লাতের গল্প ২৪ বছরও টেকেনি। জর্জ বুশ বিশ্বকে টুইন টাওয়ারের গল্প শুনিয়ে শুধু ইরাক-আফগানিস্তানই দখল করেননি, সেই গল্পের আকর্ষণে গণহত্যা মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন বিশ্বকে। মোক্ষম গল্পের রেশমি সুতায় মানুষকে বেঁধে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে।
শিশুরাই গল্প শুনতে বেশি ভালোবাসে, এটা সত্য নয়। গল্প আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই ভালোবাসে। আবার অনেক সময় শুনতে না চাইলেও শুনতে হয়। যে দেশের মানুষের বলার অধিকার সীমাবদ্ধ, সে দেশে শোনার অধিকার অবারিত।
আমাদের দেশের অবস্থাও অনেকটা তেমনই। সরকার নতুন নতুন গল্প বলে চলেছে। কিন্তু কোনোটাই শেষ করছে না। তাদের ভান্ডারে গল্পের যত বড় মজুত আছে, তত গল্প ঠাকুরমার ঝুলিতেও নেই। মুশকিল হলো এই, এসব গল্পের বেশির ভাগই অতীতকেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ত, যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কিংবা ২১ আগস্টের ভয়াবহ নাশকতার বিরুদ্ধে, তাঁরা ভাবছেন অপরাধীদের বদলে জনগণ কেন শাস্তি পাবে? আর ইতিহাস দিয়ে তো বর্তমানের জীবনযুদ্ধ সামলানো যায় না। রাজনৈতিক বাস্তবতা মোকাবিলা মানে যদি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি হওয়া হয়, তাহলে অতীতের গল্প বেশি কাজ করার কথা নয়।
ক্ষমতা যদি ধুরন্ধর হয়, তাহলে সে তার গল্প ফুরাতে দেবে না। বর্তমানে আমরা উন্নয়নের গল্পে রয়েছি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর টানেল প্রকল্প প্রায় শেষের পথে। এরপর আসতে পারে শতবর্ষ মেয়াদি বদ্বীপ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান। তবে যেভাবে দুর্নীতি বাড়ছে আর টাকা পাচার হচ্ছে, গুম-খুন ইত্যাদি নিয়ে আওয়াজ উঠছে, বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তাতে করে শুধু উন্নয়নের গল্প দিয়ে হবে না। নতুন কোনো মারাত্মক গল্প লাগবে।
তা ছাড়া মুশকিল আরও আছে। কোনো গল্পই শেষ হয় না। ছোটবেলায় শোনা রূপকথার শেষে বলা হতো, ‘নটে গাছটি মুড়োল, আমার গল্প ফুরোল’। পরে জেনেছি, গ্রামবাংলায় নটেশাক বলে একটা শাক আছে। যেখানে-সেখানে এটা হয় বলে এর অভাব হয় না, অর্থাৎ তা মরে না। হয়তো সেখান থেকেই কথাটা এসেছে, নটেগাছ যখন মরবে, তখন গল্পও ফুরাবে।
নটেশাকের অনেক উপকার আছে। গল্পও খুব দরকারি। আরব্য রজনীর ওই শেহেরজাদি জানত, যে-ই তার গল্প ফুরাবে, অমনি বাদশা তার গর্দান কেটে ফেলবেন। কোনো এক নারীর বিশ্বাসঘাতকতার শোধ নিতে তিনি প্রতি রাতে একজন নারীকে জোর করে বিছনায় নেন এবং ভোরবেলা তার শিরশ্ছেদ করেন। বুদ্ধিমতী শেহেরজাদ বুঝে ফেলেছিল, গল্পের জাদুতে বাদশাহকে আটকে ফেলতে পারলেই সে বেঁচে যাবে।
ক্ষমতা যদি ধুরন্ধর হয়, তাহলে সে তার গল্প ফুরাতে দেবে না। বর্তমানে আমরা উন্নয়নের গল্পে রয়েছি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর টানেল প্রকল্প প্রায় শেষের পথে। এরপর আসতে পারে শতবর্ষ মেয়াদি বদ্বীপ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান। তবে যেভাবে দুর্নীতি বাড়ছে আর টাকা পাচার হচ্ছে, গুম-খুন ইত্যাদি নিয়ে আওয়াজ উঠছে, বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তাতে করে শুধু উন্নয়নের গল্প দিয়ে হবে না। নতুন কোনো মারাত্মক গল্প লাগবে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিতর্কিত নির্বাচনের পরের কথা। টক শোর মাধ্যমে মুখচেনা এক বিখ্যাত সাংবাদিককে রাস্তায় পেয়ে এক বৃদ্ধ কাছে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘আমি আরও পাঁচটি বছর বাঁচতে চাই, কেন জানেন?’ সাংবাদিক বললেন, কেন? বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘এবারের নির্বাচনটা তো দেখলাম। আরও পাঁচটা বছর যদি বাঁচি, তাহলে দেখতে চাই পরের নির্বাচনটা সরকার কোন কায়দায় করে!’
পুরোনো গল্পগুলোর নটেগাছের খেত এখন অনেকটা যখন মুড়িয়ে আসছে, তখন জাতীয় জীবনের কাহিনিকারেরা পরের পর্বে নতুন কোন গল্প আমাদের শোনাবেন? কোনো গল্প শুনে মানুষ জেগে ওঠে, আবার কোনো কোনো গল্প শুনলে ঘুম পায়। জনগণ আরব্য রজনীর সেই বাদশাহর মতো গল্পের নেশায় বুঁদ। নতুন সেই গল্প জনগণকে জাগিয়ে তুলবে, নাকি ঘুম পাড়াবে?
সেই বৃদ্ধের মতো আমরাও অপেক্ষায় আছি।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন