
অর্থপাচার রোধ ও ব্যাংক সেক্টর রক্ষার অন্যতম তিন রক্ষক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী, বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম। অথচ রক্ষক হয়েও তাঁরা ভক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হয়ে তাঁরা ব্যাংক থেকে লাখ কোটি টাকা লোপাট ও সেই অর্থ বিদেশে পাচারে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের অসাধুতা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণেই ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ লোপাট ও তা পাচার সম্ভব হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্তে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি, এস আলম গ্রুপের লাখ কোটি টাকা লোপাট ও পাচার, হলমার্ক গ্রুপের হাজার কোটি ঋণ জালিয়াতি এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি পি কে হালদারের হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি ও তা বিদেশে পাচারে এসব কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদের মধ্যে পরিবারসহ এস কে সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। তাঁর স্ত্রীকেও সম্পদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই মাসুদ বিশ্বাসের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা হবে। এ ছাড়া শাহ আলমের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। শিগগিরই তাঁর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের মামলা হবে। এসব কর্মকর্তার সম্পদের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, টার্কিসহ বিশ্বের ১১টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশ থেকে যাঁরা অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আর রক্ষক হয়ে যাঁরা ভক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। দুর্নীতি করলে কারো পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
দুদকের মহাপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদকের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে জোরালো অভিযান চলছে। দুদকের মামলার আসামিরা হয় জেলে থাকবে, নয় বেলে (জামিন) থাকবে। আইনে সোপর্দ না হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ শেষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে লাখ কোটি টাকা লোপাট ও পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকসহ সরকারের অন্য কোনো সংস্থা গ্রুপটির কর্ণাধারদের দিকে তাকানোর সাহস করেনি। ঠিক একইভাবে ওই তিন ভক্ষকের বিরুদ্ধেও আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে সাহস পায়নি দুদকসহ অন্য কোনো সংস্থা।
তিনি বলেন, হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান করতে গিয়ে এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলমের সম্পৃক্ততার তথ্য পায় দুদকের তৎকালীন অনুসন্ধান টিম। ওই সময় তাঁদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যা ছিল দুদকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ক্ষমতাশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় ওই সব মামলায় তাঁদের আসামি করা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে কমিশন। অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এস কে সুর চৌধুরী, মাসুদ বিশ্বাস ও শাহ আলম একই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করতেন। এক যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা দেশ থেকে অর্থ পাচার ও ব্যাংক ধ্বংসের কারিগর হিসেবে কাজ করছেন।
এস কে সুর, মাসুদ ও আলম : ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে বিভিন্ন সময় এক কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়। কিন্তু এখনো ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। এ তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
এ ঘটনায় এস কে সুর চৌধুরীর দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। সম্প্রতি এ মামলার তদন্তভার চেয়ে সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের লাখ কোটি টাকা লোপাট ও বিদেশে পাচার, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ফান্ডেড অংশে মোট এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা লোপাট ও নন-ফান্ডেড প্রায় এক হাজার ৭১০ কোটি টাকার লোপাট এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি পি কে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদকের অনুসন্ধানে ওই সব কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসে।
গত ২৩ ডিসেম্বর এস কে সুর চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও কন্যা নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করা হয়। এরপর গত ২৭ জানুয়ারি এস কে সুরের বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের লকারে রক্ষিত তিনটি বক্সে তল্লাশি করে ৫৫ হাজার ইউরো, এক লাখ ৬৯ হাজার মার্কিন ডলার, ৭০ লাখ টাকার এফডিআর ও এক হাজার ৫ দশমিক ৪ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
গত ১৯ জানুয়ারি এস কে সুরের ধানমণ্ডির বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি এস কে সুরকে গ্রেপ্তার করে দুদক। অপর কর্মকর্তা শাহ আলমের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলমান। শিগগিরই তাঁর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের মামলা হবে। এ ছাড়া ১ জানুয়ারি এক কোটি ৮৭ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মাসুদ বিশ্বাসের স্ত্রী কামরুন্নাহারের নামে ৭২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬(১) ধারায় পৃথক সম্পদ বিবরণী নোটিশ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধেও মামলার প্রস্তুতি চলছে।